
‘ডিলিমিটেশন, অহিন্দি রাজ্যের উপর তলোয়ার’- স্ট্যালিনের চিঠি মমতা সহ সাত মুখ্যমন্ত্রীকে
১৫ মার্চ, কলকাতা: তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিন ডিলিমিটেশন বিষয়ে সাতটি অহিন্দি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে জয়েন্ট অ্যাকশন কমিটিতে(JAC) যোগ দেওয়ার জন্য চিঠি দিয়েছেন। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ভগবত মান, কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন, কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া, অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডু, তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী রেবন্ত রেড্ডি, এমনকি ওড়িশার বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী মোহন চন্দ্র মাঝিকেও আমন্ত্রণ জানিয়েছেন এম কে স্ট্যালিন আগামি ২২ মার্চ JAC তে যোগ দেওয়ার জন্য।স্ট্যালিন বলেছেন, “এই মুহূর্তটি নেতৃত্ব এবং সহযোগিতার দাবি করে – রাজনৈতিক পার্থক্যের ঊর্ধ্বে উঠে বৃহত্তর কল্যাণের জন্য দাঁড়ানো,” তিনি আরও লিখেছেন, “রাজ্যগুলির ন্যায্য সম্পদ সুরক্ষিত করার, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার উপর গুরুত্বপূর্ণ নীতিগুলিকে প্রভাবিত করার এবং রাষ্ট্রীয় কর্মসূচিতে আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রাধিকারগুলিকে যথাযথ মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতা সম্পর্কে আমাদের একসাথে দাঁড়াতে হবে – পৃথক রাজনৈতিক সত্তা হিসাবে নয়, বরং আমাদের জনগণের ভবিষ্যতের রক্ষক হিসাবে।”সিদ্দারামাইয়াকে লেখা তিন পৃষ্ঠার চিঠিতে স্ট্যালিন সতর্ক করে দিয়েছেন যে, ২০২৬ সালের পরে, পরবর্তী আদমশুমারির ভিত্তিতে আসন পুনর্বণ্টন করা হলে রাজনৈতিক দৃশ্যপট নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হতে পারে। “যেসব রাজ্য তাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং উচ্চতর শাসন সূচক অর্জন করেছে, তাদের রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণের মঞ্চে প্রতিনিধিত্ব হ্রাসের শাস্তি দেওয়া হবে।”সিদ্দারামাইয়া এই বিষয়টির তাৎপর্য স্বীকার করেছেন, বিশেষ করে নতুন জনসংখ্যার মানদণ্ডের ভিত্তিতে সংসদীয় ও বিধানসভা নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণের বিষয়ে। তিনি আলোচনায় অংশ নিতে তার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন কিন্তু পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি থাকায় তিনি উপস্থিত থাকতে পারবেন না। তিনি জানিয়েছেন,”যদিও আমি সভায় অংশগ্রহণ করতে চাই, আমার সময়সূচীর কারণে, আমি তা করতে পারছি না। তাই, আমি উপ-মুখ্যমন্ত্রী ডি কে শিবকুমারকে আলোচনায় অংশ নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছি।” কেন্দ্রের এই পদক্ষেপের সমালোচনা করে সিদ্দারামাইয়া আরো বলেন “ডিলিমিটেশন গণতন্ত্রকে দুর্বল করে এবং সংবিধানের যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতি লঙ্ঘন করে….কর্ণাটক তার অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছে – আমরা এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে সমর্থন করব।”কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ দক্ষিণ রাজ্যগুলিকে আশ্বস্ত করেছেন যে তাদের এই পরিণতি সম্পর্কে ভয় পাওয়ার দরকার নেই, ডিলিমিটেশনের ফলে আসন সংখ্যা আনুপাতিক হারে হ্রাস পাবে না এবং এর ফলে একটিও দক্ষিনী রাজ্য প্রভাবিত হবে না। কিন্তু এই বক্তব্য যে অর্ধসত্য তা সকলেই জানে। অহিন্দি রাজ্যের আসন না কমলেও হিন্দি বলয়ের আসন এত সংখ্যা বাড়বে যে ভারতে অহিন্দি রাজ্য অধিকারের অলিন্দ থেকে সরে যাবে। স্ট্যালিন বলেছেন- ডিলিমিটেশনের তলোয়ার ঝুলছে দক্ষিনী রাজ্যগুলির উপর, একে ভোঁতা করতে হবে। ডিলিমিটেশনের সমস্যা কী ? ডিলিমিটেশন হল লোকসভা এবং রাজ্য বিধানসভার আসন সংখ্যা নির্ধারণ এবং নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণের প্রক্রিয়া। এটি তফসিলি জাতি (SC) এবং তফসিলি উপজাতি (ST) এর জন্য কতগুলি আসন সংরক্ষিত তাও নির্ধারণ করে। এই অনুশীলনটি ১৯৫১, ১৯৬১ এবং ১৯৭১ সালের আদমশুমারির পরে পরিচালিত হয়েছিল। ৭১ সালে দেখা গেল অহিন্দি বলয়ের জনসংখ্যা স্বাভাবিক ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। কিন্তু হিন্দি বলয়ে জনসংখ্যা উত্তরোত্তর বেড়েছে। সুতরাং আসন পুনর্বিন্যাস করতে গেলে ভারতের অহিন্দি রাজ্য বঞ্চিত হবে এবং ভারতের ফেডেরাল কাঠামো ভেঙে পড়বে। তখন এই বিন্যাস ২০০০ সাল পর্যন্ত স্থগিত করে দেয় ইন্দিরা সরকার। এবং হিন্দি বলয়ের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের উপর জোর দেওয়া হয়। ২০০১ সালে অটল সরকারও বিপদ উপলব্ধি করে ২০২৬ পর্যন্ত স্থগিত করেন। সামনে ২০২৬ । ডিলিমিটেশনের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে মোদী সরকার। জনসংখ্যার বৈষম্য অব্যাহত থাকায় ডিলিমিটেশন আগামী ত্রিশ বছর পর্যন্ত স্থগিতকরণ আরও বাড়িয়ে দেওয়ার কথা বলছেন স্ট্যালিন।যদি ২০২৬ সালের আদমশুমারির ভিত্তিতে আসন পুনর্বণ্টন করা হয়, তাহলে উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্যগুলি আরও বেশি আসন পাবে, অন্যদিকে দক্ষিণ এবং ছোট উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্যগুলি রাজনৈতিক প্রভাব হারাতে পারে।মোট আসন ৫৪৩টি রাখা হবে কিনা, কিন্তু রাজ্যগুলির মধ্যে পুনর্বণ্টন করা হবে কিনা, নাকি মোট আসন ৮৪৮-এ উন্নীত করা হবে, যাতে সমস্ত রাজ্য আরও বেশি আসন পাবে, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।উভয় ক্ষেত্রেই, দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্যগুলি,পশ্চিমবঙ্গ, পাঞ্জাব, হিমাচল প্রদেশ এবং উত্তরাখণ্ডের মতো ছোট উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্যগুলি এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলির আসন সংখ্যা রাষ্ট্রীয় গড় বৃদ্ধির তুলনায় কম শতাংশ হরে বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। এটির ন্যায়সঙ্গতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে অহিন্দি রাজ্যের অধিবাসীরা, কারণ যেসব রাজ্য তাদের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রেখেছে তাদের প্রতিনিধিত্ব কমে যাবে সংসদে। এটি ১৯৭১ সালের আদমশুমারির ভিত্তিতে আসন নির্ধারিত করার মূল ধারণারও পরিপন্থী।যদি ৫৪৩ আসন রাখা হয় বাংলা সহ দক্ষিণের রাজ্যগুলি আসন হারাবে। যদি ৮৪৮ আসন করা হয় উত্তরের রাজ্যগুলির আসন এত বৃদ্ধি পাবে অহিন্দি রাজ্যগুলি সংসদে সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে। দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্যগুলিতে বর্তমানে আসন সংখ্যার ২৪% ভাগ রয়েছে, সেখানে আসন সংখ্যা ৫% কমে যাবে। একটি পরিসংখ্যান দেওয়া হল।আসন সংখ্যা ৫৪৩ থাকলে- আসন সংখ্যা জনসংখ্যা অনুসারে বেড়ে ৮৪৮ হলে- সূত্রঃ Vaishnab et al, Carnegie Endowment রাজ্য থেকে যে পরিমাণ কর কেন্দ্রে যায় তার কত শতাংশ কোন রাজ্য পায়, সেদিকে তাকালে দেখা যাবে তামিলনাড়ু ১ টাকায় ফেরত পায় ২৯ পয়সা, কর্নাটক পায় ১৫ পয়সা সেখানে বিহার ১ টাকায় পায় ৭ টাকা, উত্তরপ্রদেশ পায় ২ টাকার বেশি। অহিন্দি জাতির টাকায় উত্তরের রাজ্যগুলি প্রতিপালিত হয়। অথচ দক্ষিণের রাজ্যগুলি, পাঞ্জাব বাংলা ওড়িশা কার্যত হিন্দির উপনিবেশে পরিণত হবে। হিন্দি ভাষা বিতর্কে ভারতের শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান সংসদে বলেছেন-“সস্তা রাজনীতির জন্য আপনারা তামিলনাড়ুর ছাত্র সমাজের ভবিষ্যৎ নষ্ট করছেন। আপনারা অসৎ, অসভ্য। ব্রিটিশ ঔপনিবেশকতা সরিয়ে হিন্দির উপনিবেশ হতে আপনাদের এত আপত্তি কীসের।” অর্থাৎ হিন্দি বলয়ের মানসিকতা স্পষ্ট। এখন দেখার বিষয় বাংলার মুখ্যমন্ত্রী কীভাবে সাড়া দেন।